'সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস' আর শিক্ষার হারের যোগসূত্র

এই সময়ে আমাদেরকে ঘিরে আছে হাজারো ডাটা। কোটি কোটি ডাটা। নিউজ ফোরাম আর সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর সেকেন্ডে তৈরি হচ্ছে আরো অনেক ডাটা। এতো ডাটা পড়ার সময় কই আমাদের? আর সেটা পড়ে যদি 'প্রজ্ঞা'টাই না নিতে পারি তাহলে আমরাই বা আছি কি করতে?

ঠিক তাই। আপনার কোম্পানির ওয়েবসাইটের কমেন্ট বক্সের পাশাপাশি টেক্কা দিয়ে বাড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাগ-ইন। মানে আপনার ফেইসবুক পেজের কমেন্ট চলে আসছে এক জায়গায়। আপনার কোম্পানি বা আপনার একটা প্রোডাক্ট নিয়ে মানুষ কি ভাবছে সেটা জানতে পড়তে হবে প্রতিটা কমেন্ট। সময় বা রিসোর্স আছে আপনার?

না নেই। আর সেটা নেই কারোরই। সেখানে আসছে 'সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস'। মেশিন পড়বে প্রতিটা জিনিস। মানুষের মতো করে। ধারণা করবে - মানুষ কি চাচ্ছে এখানে? তৈরি করে দেবে তার ভেতরের 'ইনসাইট' মানে মেসেজটা। মানুষের মতো করে চিন্তা করে। মানুষ কি রাগান্বিত না খুশি - না, সে কেয়ার করে না - সেটাও দেখবো এখানে। সনাতন ভাষায় আমরা এটাকে বলি 'বিজনেস ইন্টেলিজেন্স'। ব্যাপারটা চলে আসছে অনেক অনেক বছর ধরে। আগে সেটা ছিলো প্রতিষ্ঠানের ভেতর। এখন বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন লেভেলে।

আমরা শুরু করবো ইংরেজি দিয়ে। সামনে আসবো বাংলায়। তার আগে অক্ষর চেনা। হাতে লেখা অক্ষর। প্রথমে ইংরেজি অক্ষর। তারপর বাংলায়।

আছেন তো আমাদের সাথে?

শুরুতেই গল্প।

নব্বইয়ের দশক। ইন্টারনেট আসেনি তখনো। যা আছে সেটাকে আমরা বলি ‘অফলাইন’ ইন্টারনেট। মানে, সারাদিনের মেইল একসাথে লিখে ফেলে রাখতাম মেইল ক্লায়েন্টের কিউতে। রাতে যখন ফোনের খরচ কম - তখন ডায়াল করতাম সিঙ্গাপুরে। ‘ইউনিক্স টু ইউনিক্স’ প্রটোকলে মেইল আর ‘নিউজ’ চলে যেতো আর আসতো সিঙ্গাপুর থেকে। সিঙ্গাপুরে যাওয়া মানে বিশ্বের সাথে যুক্ত হওয়া। আজকে যেটা ফেইসবুক, সেধরণের বেশকিছু ফোরামে যুক্ত ছিলাম ওই সময়ে। ইউনিক্স আর লিনাক্স প্রযুক্তির প্রতিদিনের সমস্যা নিয়ে কথা হতো বিশ্বের সেরা মাথাগুলোর সাথে। পাশাপাশি ‘শর্টওয়েভ লিসেনিং’ এর অ্যান্টেনা ডিজাইনের জন্য আইডিয়া আসতো কয়েকটা নিউজগ্রূপ থেকে।

নিউজগ্রূপে যে ‘ফ্লেমিং’ হতো না তা নয়। মানে, একজন একটা কথা বলেছে সেটাকে দাবিয়ে দেয়া - অথবা অন্যকে তাচ্ছিল্য করে ব্যঙ্গ করা - এগুলো হতো কম তখন। মানে, বছরে দুটো তিনটে ঘটনা। অনেক অনেক কম। মানুষ কম যে ছিলো তাও নয়। পঞ্চাশ হাজারের বেশি গ্রাহক ছিলো ওই লিনাক্স নেটওয়ার্কিং গ্রূপে। সারা বিশ্ব জুড়ে। একজন একটা ভুল বললেও সেটাকে কিভাবে তাঁকে ‘হার্ট’ না করে তার ভুল শুধরে দেয়া যায় সেটা দেখেছি নিজ চোখে। হাজারো ইভেন্টে। বছরের পর বছর। অনেক ভুল ইনপুটে রেসপন্স না পেলে মানুষ বুঝে যেতো কোন একটা সমস্যা আছে সেখানে। তার মানে, মানুষ জানতো ‘হোয়েন টু শাট-আপ’। দাম দিতো ভিন্নমতের। অন্য লেভেলের জিনিস।

আমি নিজে ‘মাল্টি ন্যাশনাল’ এনভায়রনমেন্টে কাজ করেছি বেশ সময় ধরে। বার কয়েক। কেউ ইংরেজি অল্প বোঝে, কেউ বা বোঝে না। সমস্যা হয়নি। কারণ - ওই এনভায়রনমেন্টে আমাদের ‘শক-অ্যাবজরভার’এর রেঞ্জ অনেকটাই ‘ওপেন এন্ডেড’ থাকতো। না থাকলেই বিপদ। ওখানে সে টিকতে পারবে না। চলতে হয় সবার সাথে তাল মিলিয়ে। সবার ‘কালচার’ আলাদা। অসম্ভব ‘সেনসেটিভ’ থাকতে হয় অন্যদের ব্যাপারে। সবার সেন্টিমেন্ট বুঝে চলতে হয়।

অনেকেই বলেন আমরা বোঝার আগেই চলে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া। তাই 'রেডিনেস' আসেনি। সে ব্যাপারে আমি কমেন্ট করবো না। তবে ‘ইন্টারনাল অ্যানালাইসিস’ বলে আমাদের ভেতরের সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন ফোরাম আর মিডিয়ার ওয়েবসাইটে মানুষের মনোভাব প্রকাশে এখনো পরিপক্কতা আসেনি। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হতে সময় লাগছে কিছুটা। এটার সাথে মানুষের আসল শিক্ষার একটা কো-রিলেশন মানে সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি ইদানিং। বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে মানুষের মানবিক শিক্ষার অভাব প্রকট। একটা মানুষের ওপর ‘ইন্টারনেট রিসার্চ’ করলে অনেককিছুই পাওয়া যায় এখন। তার আক্ষরিক পড়াশোনা নয়, বরং আসল পড়াশোনা মানে 'মেন্টাল সেটআপে'র একটা ধারণা পাওয়া যায়। এটাকে এখন ব্যবহার করছে অনেক প্রতিষ্ঠান।

সেখানেই চলে আসছে ‘সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস’। ব্যাপারটা এখন এতোটাই গুরুত্ব পাচ্ছে যখন ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট ভিসা প্রার্থীদের পাঁচ বছরের সোশ্যাল মিডিয়ার কর্মকান্ড দেখতে চাইছে নতুন রেগুলেশনে। তার মানে মানুষের প্রতিটা পোস্ট আর তার কর্মকান্ডের একটা ‘সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস’ চলছিলো অনেকদিন ধরে। সেটার একটা ‘প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ’ ব্যাপারটা চলে আসছে সামনে। আমি ‘প্রাইভেসি’র ইস্যু নিয়ে কথা বলবো না - কারণ প্রযুক্তির সক্ষমতা নিয়ে আমার এই বই।

আপনি চান বা না চান, ব্যাপারটা ঘটছে অনেক আগে থেকেই। একেকটা মানুষের পাঁচ বছরের প্রোফাইল বসে বসে পড়ার জন্য তো আর মানুষ থাকবে না। ইন্টারনেটে মানুষের ‘পজিটিভ’ ‘নেগেটিভ’, নিউট্রাল মতামতের ওপর বহুদিন ধরেই চলছে ‘ওপিনিয়ন’ মাইনিং। মানুষের মতামত, সেটা নেগেটিভ না পজেটিভ নাকি নিউট্রাল, না মতামতটা অন্য কী বিষয়ের ওপর ডিপেন্ডেন্ট, সেটা জানা জরুরি বরং। ইন্ডাস্ট্রিগুলো এখন মানুষের মুড ক্লাসিফিকেশন, তার মনের ভেতরের ইমোশন অ্যানালাইসিস করছে,বহুদিন ধরে।

কয়েকটা ‘হিন্ট’ দেই। ধরুন, একটা ডকুমেন্ট কি বলছে সেটার সেন্টিমেন্ট না জানলে এইযুগে কাজ করে লাভ কী? ডকুমেন্ট সেন্টিমেন্ট ক্লাসিফিকেশন, একটা বাক্যের ভেতরে কিভাবে ‘সাবজেক্টিভিটি’ আসে সেটা জানছে কিন্তু ডীপ লার্নিং। আগে বলুন কোটি কোটি কমেন্ট পড়ার সময় আছে কি আমাদের? সেখানেই এই ডীপ লার্নিং এর মুন্সিয়ানা। আরেকটা জিনিস বলে রাখি। 'কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা' কি বলেছিলো? একটা মানুষের মতামত পাল্টাতে মানে নিজের দিকে নিয়ে আসতে - হাত দিতে হবে একদম তার 'কালচারে'।

'কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা' ডাটা চুরির পক্ষে কোন 'জাস্টিফিকেশন' তারা তৈরি করতে পারবে না - তবে তাদের মানুষের সম্পর্কে 'ইন্টারনাল অ্যানালাইসিস' অনেকটাই পরিপক্ক ছিলো। তাদের কাজ করার পদ্ধতি ভুল ছিলো, তবে 'অ্যালগরিদম' (ভেতরের কিছু ডকুমেন্ট দেখে মনে হলো) চলে এসেছে অন্য লেভেলে। এদিকে, মানুষের মতামত কিন্তু অন্য অনেক কিছুর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ওই এক্সটার্নাল ফ্যাক্টরগুলো জানলেই কেল্লাফতে। তার মানে এখানে অনেকগুলো সাইকোলোজিক্যাল ফ্যাক্টর কাজ করছে। এই ক্যাঁচাল বুঝবে কে? এখানেই আসছে ডীপ লার্নিং। সাথে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং। সেখানেও ডীপ লার্নিং। যাবেন কোথায়?

টেলিকম নিয়ে কাজ করি বলে বন্ধুবান্ধব পৃথিবী জুড়ে। একটা কথা প্রায় শুনি। অনেককাল থেকেই চাকরি পাবার আগে বিশাল ভেটিং হয় সোশ্যাল মিডিয়াতে, বিভিন্ন ফোরামে। ইন্টারনেটে। সত্যিই তাই। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীব্যাপী সশস্ত্রবাহিনীতে নেবার আগে কয়েকদিন ধরে সাইকোলোজিক্যাল পরীক্ষা নেবার পেছনে যতগুলো ‘কগনিটিভ’ স্কিলসেট দেখা হয় তার মধ্যে ‘নেগেটিভিটি’ একদম বাদ। একটা প্রতিষ্ঠানকে শেষ করে দিতে পারে কয়েকটা ‘টক্সিক’ মানুষ। টীমওয়ার্ক তো শেষ আগেই। তাই এখন সবাই রিসার্চ করে নেয় ইন্টারনেটে। সেখানে সাহায্য করছে ডীপ লার্নিং।

তো, বাকি থাকে কী?

কথা বলছিলাম ইন্টারনেট পোস্ট, খবর, সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতার একটা সম্পর্ক বের করতে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ইনপুট নিয়ে ইউনিভার্সিটি’র র‌্যাঙ্কিং ইভালুয়েশন চলছে বেশ আগে থেকেই। সেখানে মানুষের পোস্ট, তার লেখার ধরণ, বানান ভুলের ফ্রিকোয়েন্সি, বাক্য গঠনের আইডিয়া, বাক্য গঠনে পজিটিভিটি, নেগেটিভিটির ব্যবহার, কার সাথে চলেন, সবকিছুই বেশ বড় একটা ধারণা দেয় তার প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে। সেই সাথে মানসিক অসুস্থতার একটা ইনডেক্স তৈরি করা যায় এখন থেকে।

সেখানে (“হাতেকলমে মেশিন লার্নিং” বইটা পড়া থাকলে বুঝবেন ভালো) বিভিন্ন ফীচার সিলেকশন টেকনিক, ‘কনটেক্সট’ বোঝা - ‘ফরম্যালি’ না ‘ইনফরম্যালি’ বলেছেন, দিনে বলেছেন না রাতে বলেছেন, তার ‘লেক্সিকন’, এন-গ্রাম, বাক্যের মধ্যে ক্রেডিবিলিটি কতোটুকু, নাকি সব সময় ফালতু কথা বলেন - এর সবকিছু চলে আসবে একটা মানুষের প্রকৃত শিক্ষার মান বের করতে। পাশাপাশি পোস্টের মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া সার্কাজম, অসমাপ্ত বাক্য, গালিগালাজ বুঝতে লাগবে ডীপ লার্নিং। এগুলোর জন্য দরকার ডীপ লার্নিং এর আরো হিডেন লেয়ার।

[ক্রমশঃ]

Last updated