স্পিকার নিয়ে কথাবার্তা

অনেকেই বলছিলেন স্পিকার নিয়ে লিখতে। লিখেছিলাম কিছু সত্যি, সেটাকে নতুন করে লিখছি গোড়া থেকে।

মনে আছে, ছোটবেলায় পাড়া মহল্লায় অনেক অনুষ্ঠান হতো কিন্তু। অনুষ্ঠানের মূলে থাকতো কয়েকটা মাইক। মনে করে দেখুন ভালো করে। প্যান্ডেলের চার দিকে চারটা মাইক লাগালে পুরো এলাকা অস্থির। মাইকআলা’র দাপটই অন্যরকম। ঠিক করেছিলাম বড় হলে দোকান দেবো মাইকের। আর চকলেটের। ওই অনুষ্ঠান শুরুর আগে গান, অনুষ্ঠানের হাফটাইমে গান - অনুষ্ঠানের পরে গান। মাফ নেই। আহ, কি দিন ছিলো তখন? বাসা থেকে পালিয়ে চলে যেতাম ওই জায়গাগুলোতে। বাবা, মা - রাগ করতেন না অতোটা। কারণ, সবাই চিনতেন সবাইকে। একটা গ্যান্জাম করেছি - সেটা চলে বাসায় আসতো - বাতাসের আগে আগে। বাসায় ফিরে দেখতাম সবার মুখ থমথমে। এর পর? সবাই জানি পরের কাহিনী কি?

ফিরে আসি অনুষ্ঠানের মূল আয়োজনের দিকে। হ্যাঁ, মাইকের কথা বলছি। হর্ন টাইপের স্পিকার। স্পিকার বটে, লাউডস্পিকার। ওর একটাই কাজ। শব্দকে বড় করে অনেক দুরে নেয়া। সত্যি কথা বলতে সেটাতে সে ওস্তাদ। বস ম্যান! মাইকের পেছনের গোল জিনিসটাই আসল। অনেক সময় দেখতাম - দোকানে ঝুলিয়েছে মাইক ওই গোল জিনিসটা ছাড়াই। মানে, সারাতে দিয়েছে ওই গোল জিনিস। পেছনের ওই গোল জিনিসটাই আসল। শব্দ হয় ওটা থেকেই। এটাকে বলে ‘ড্রাইভার’। ওই ড্রাইভার থেকে শব্দগুলো গিয়ে বাড়ি খায় মাইকের ভেতরের নাকের মতো উঁচু জিনিসটাতে। ভেতর দিক দিয়েই। ওই নাকের মতো জিনিসটা শব্দকে আবার বাড়ি দিয়ে ফেরৎ পাঠায় মাইকের গায়ে। পরে - মাইকের গা থেকে রিফ্লেক্ট হয়ে জোরে দৌড় দেয় সামনের দিকে। ওই দৌড়ই হচ্ছে মাইকের জোরে শব্দ হবার পেছনের গল্প।

এখন অনুষ্ঠান হয় বটে, সেটা অনেক কম। মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেক বেশি। নিজেকে নিয়ে। হবার কথা। এখন খুব একটা যাওয়াও হয় না পড়শীদের বাসায়। তবে, ঈদে শোনা যায় গান বাজনা কিছুটা। তবে সেটা আর মাইকে নয়। বড় বড় স্পিকারে। বিশাল বড় আকারের। ‘স্পিকার’ শব্দটা এসেছে কিন্তু ওই ‘লাউডস্পিকার’ থেকে। ইলেকট্রনিক্সের যুগে শব্দ দিয়ে যাই করি না কেন সেটাকে পাল্টে নিতে হয় ইলেকট্রিক সিগন্যালে। ওই ইলেকট্রিক সিগন্যালকে আবার আগের মতো করে শুনতে হলে যে যন্ত্রপাতি দরকার সেটাই ‘লাউডস্পিকার’ আকা ‘স্পিকার’।

একটা স্পিকারে থাকে কি? ১. প্রথমে বাক্স একটা। পালিশ করা বাক্স। বাক্স কিন্তু খালি বাক্স নয়। এই এনক্লোজার নিয়ে আছে অনেক গল্প। শব্দকে ধারণ করতে যেই সেই বাক্স হলে বিপদ। ২. বাক্স খুললেই গোল বড় চুম্বক চোখে পড়ে সবার আগে। সেটার সামনে থাকে একটা কাগজের ডায়াফ্রাম। এটাকেই বলা হয় ড্রাইভার। একটু ভালো স্পিকার হলে সেখানে থাকে কয়েকটা ড্রাইভার। দুটো ড্রাইভারের স্পিকারই বেশি। ৩. একটা ড্রাইভার হলে বাইরের তার এসে লাগে ওই ড্রাইভারে। সোজা হিসেব। দুটো হলেই বিপদ। তখন সেই তার এসে লাগে মাঝের ছোটখাট একটা সার্কিট বক্সে। ওই সার্কিট থেকে তারটা নতুন করে ডিস্ট্রিবিউট হয় দুটো ড্রাইভারে। এই সার্কিট বক্সটাই হচ্ছে ‘ক্রসওভার নেটওয়ার্ক’। মজার কথা, এই ক্রসওভার নিয়েই লেখা যাবে এরকম একটা বই।

ড্রাইভারের গল্প দিয়েই শুরু করি বরং। দুনিয়ায় হাজার রকমের ড্রাইভার থাকলেও তাদের কাজ একটাই। ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল থেকে শব্দ তৈরী করা। হোক সেটা কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ অথবা কিংকংয়ের হুঙ্কার! আর এই সাউন্ড ওয়েভ তৈরী করতে কাঁপাতে হবে বাতাসকে। বাতাসকে কাঁপাবে কাগজের ‘কোন’ আকৃতির ডায়াফ্রাম। ডায়াফ্রাম হচ্ছে স্পিকারের মুভিং পার্টস। আর এই ডায়াফ্রামকে কাঁপাতে আমরা নিয়ে আসবো একধরনের ‘ইলেক্ট্রো-ডাইনামিক পিস্টন ড্রাইভার’। এই জায়গায় সবচেয়ে পরিচিত প্রযুক্তি হচ্ছে কয়েলের ভেতরে আপ ডাউন করার সক্ষমতাসহ গাড়ির মতো একটা ‘পিস্টন’। এই পিস্টনটা ডায়াফ্রামকে এমনভাবে ওঠানামা করাতে হবে যাতে বাতাসকে সে কাঁপাতে পারে ঠিকমতো। একসুতো বেশি কম করলেই বিপদ। এতোটাই সুক্ষ যে ওপরদিকে সেকেন্ডে ২০ হাজারেরও অনেক বেশি আপডাউন করতে পারতে হবে আমাদের এই পিস্টনকে। ভয়ঙ্কর, তাই না?

আমার দেখামতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুক্ষ কান হচ্ছে নিউ মেক্সিকোর ভেরি লার্জ এন্টেনা (ভিএলএ) অ্যারে। ওর কয়েকটা আছে আবার ক্যানবেরার ডিপ স্পেস কমিউনিকেশন কমপ্লেক্সে। যারা কার্ল সাগানের ‘কন্টাক্ট’ মুভিটা দেখেছেন তারা জানবেন ভালো। ২৭টা শত ফুটের এন্টেনা কান খাড়া করে শুনছে ডিপ স্পেস থেকে পাঠানো হাজারো দুর্বল সিগন্যাল। আমাদের হাতের কাছে আরেকটা মিরাকল হচ্ছে ‘এমআরআই’ মেশিন। মানুষের শরীরের ভেতরের রেডিও আর ম্যাগনেটিক ওয়েভ শুনে আলবৎ তৈরী করে ফেলে একেকটা ছবি। ভেতরে না খুলেই। সেখানে এই স্পিকার কিন্তু কম ‘সফসটিকেটেড’ নয়। একেকটা স্পিকার খুলি আর মুগ্ধ হয়ে থাকি সারামাস। এর কারুকাজ ওই ‘এমআরআই’ মেশিন থেকে কম নয়।

ফিরে আসি ডায়াফ্রামে। স্পিকারের ভেতরের ড্রাইভারদের কোনগুলোর মধ্যে বড়গুলো বানানো হয় কাগজ দিয়ে। তাই বলে কটকটির কাগজ দিয়ে নয় নিশ্চয়ই। ভালো করে দেখলেই বুঝবেন ছোট ড্রাইভারগুলোর কোনগুলো তৈরী হয় কাপড় দিয়ে।

এটা ঠিক, ধাতুর ও হয় কোথাও কোথাও। তবে, সেটা বেশ কম। প্রশ্ন হতে পারে এতো সাইজের ড্রাইভার কেন? কেন নয় একটা ড্রাইভার? কারণ, শব্দ তো আসছে একই সোর্স থেকে! ছোটবেলার রেডিওর মতো। আমারও প্রশ্ন ছিলো এটাই। বন্ধুর কাছে। হাসলো বন্ধু। বরাবরের মতোই।

সমস্যা অন্যখানে। মানুষ শুনতে পারে ২০ হার্টজ থেকে ২০,০০০ হার্টজ পর্যন্ত। এটা বেশ বড় রেঞ্জ নয় শুধু - অনেক অনেক বড় রেঞ্জ। আসলেই তাই। এই এক পিস্টন দিয়ে এতো বড় রেঞ্জ বানানো অসম্ভবই নয়, এটা পারবে না কেউ। এর পেছনের কারণ কিন্তু সোজা। বলবো?

মানুষ সবচেয়ে ছোট যে ফ্রিকোয়েন্সিটা শুনতে পারে সেটার ওয়েভ লেন্থ হচ্ছে ৩০ ফুট। মাত্র! সেটার ডায়াফ্রাম কতো হতে পারে সেটা বুঝে নিন এখন। অনেক অনেক বড়। এদিকে সবচেয়ে ছোট ফ্রিকোয়েন্সিটা যেটা শুনতে পারে মানুষ, বাদুড় নয় - সেটার ওয়েভ লেন্থ হচ্ছে ২০ মিলিমিটার। প্রায় ০.৮ ইঞ্চির মতো। সেটার ড্রাইভার কতো ছোট হবে সেটা আর বলছিনা এখানে।

বুঝলি বুদ্ধু, বললো বন্ধু। আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে প্রশ্ন করলাম আরেকটা।

যে যাই বলুক, নিচের দিকের ফ্রিকোয়েন্সি তৈরী করতে আমাদের লাগবে বড় ড্রাইভার। মানুষ সবচেয়ে ছোট যে ফ্রিকোয়েন্সিটা শুনতে পারে সেটা ৩০ ফুটের ওয়েভ লেন্থ হলেও ওই মাপের ড্রাইভার তৈরী করবে কে? দরকারও নেই। বরাবরের মতো ড্রাইভারের পরিধি কমিয়ে আনতে হাজির হয়েছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি। ঠিক যেভাবে ছোট সাইজের এন্টেনা তৈরিতে সাহায্য করছে আমাদের। এখানে আসবে কনভিনিয়েন্স, সাধ আর সাধ্যর ব্যাপার। আর সে জায়গায় আসবে আমাদের মুন্সিয়ানা। আর এটাও ঠিক যে আমরা যে শব্দ শুনি সেটার পুরোটা তো রিপ্রোডাকশন চাই না কেউ। ওই বড় রেঞ্জের একটা অংশ ধরেই হলে খুশি আমরা। আর সে কারণে দরকার হচ্ছে মাল্টি ওয়ে সিস্টেম। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে পৃথিবী জুড়ে ‘টু ওয়ে’ স্পিকার সিস্টেমের ছড়াছড়ি। কনভিনিয়েন্স। ছোট ডায়াফ্রামের ‘টুইটার’ কাভার করে উচ্চমার্গের ফ্রিকোয়েন্সিগুলোকে। ওই রেঞ্জের ভেতর মধ্যমানের ফ্রিকোয়েন্সি থেকে লো এন্ড পুরোটাই দেবে বড় ডায়াফ্রামের ‘উফার’। আর পারফেক্শনিস্টদের জন্য থাকছে ‘থ্রি ওয়ে’, মানে, মিড রেঞ্জের জন্য একেবারে ‘আলাদা’ উফার। মোদ্দা কথা, তিন ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ ধরে তিনটা ড্রাইভার।

ড্রাইভারের সাইজ ছাড়াও উফারের সাথে টুইটারের আরেকটা পার্থক্য আছে বড়। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন টুইটারের পেছন দিকটা বন্ধ। আমরা বলি ‘সীলড ব্যাক’। পেছনে আটকানো থাকে বলে এর শব্দ বের হবার রাস্তা সামনের দিক দিয়ে। সেদিক দিয়ে উফার হচ্ছে ‘ওপেন ব্যাক’। পেছনে খোলা বলে এর শব্দ বের হবার রাস্তা সামনে পেছনে দুদিকেই। স্বভাবতই মিরর ইফেক্ট আসবে এখানে। সেখানে কোনটা ব্লক করে কোনটা খুলে দিতে হবে সেটাই প্রফেশনাল কাজ। আর সেকারণে স্পিকারের বাক্স ডিজাইনে এসেছে অনেক ভ্যারিয়েশন। কারো খোলা পেছনে - সামনে - পাশে। কারো খোলা সবদিকে।

সামারী হলো, টুইটার হচ্ছে সবচেয়ে ছোট ড্রাইভার যারা কাজ করে উঁচু ফ্রিকোয়েন্সি আর সবচেয়ে ছোট ওয়েভ লেন্থ নিয়ে। আর সবচেয়ে বড় ড্রাইভার হচ্ছে এই উফার, যার কাজ নিচের ফ্রিকোয়েন্সির বড় বড় ওয়েভ লেন্থ বের করে দেয়া। অনেক হাই-এন্ডে চারটার মতো ড্রাইভার ব্যবহার করে মাঝের মিড ফ্রিকোয়েন্সিগুলোকে ঠিকমতো রিপ্রেজেন্ট করতে। ‘মিড’ প্রসেস করা বেশ কঠিন - কারণ এখানেই আছে ভয়েস থেকে বেশিরভাগ মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টের উপস্থিতি। একটা ড্রাইভারকে ক্রস-সেকশনে কাটলে যেরকম লাগে সেটার একটা ছবি বের করে দেখতে পারেন ইন্টারনেটে। মনে হবে কমপ্লেক্স কিছু নয় তবে এটার ম্যানুফ্যাকচারিং বেশ কঠিন। দেশে। প্রিসিশন ম্যাটেরিয়াল বলে হয়তোবা। ম্যাগনেটের সাথে ভয়েস কয়েলের, (আবার - অনেক ড্রাইভারের সাথে থাকে বেশ কয়েকটা কয়েল) ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ বেশ জটিল। আমরা এর ভেতরে খুব একটা যাবো না কারণ ড্রাইভার তৈরী করতে যাবো না আমরা। স্পিকার তৈরী করতে ড্রাইভারকে সবচেয়ে ছোট মডিউল হিসেবে নেব আমরা। সত্যি বলতে, বেশ ভালো ভালো ড্রাইভার ওই স্পিকারের ভগ্নাংশ দামে পাওয়া যায়।

একটা জিনিস ভেবেছেন কি? স্পিকারে তার ঢুকছে একজোড়া। অথচ ড্রাইভার হচ্ছে দুটো, ক্ষেত্র বিশেষে তিনটা। ওই তার দিয়ে অ্যাম্পলিফায়ার ঘুরে যে অডিও সিগন্যাল আসছে সেখানে তো আছে সব ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি। আমি আগে ভাবতাম সব ড্রাইভারে ‘প্যারালাল’ কানেকশন দিলেই তো যায় ল্যাঠা চুকে। কিসের কি? পরে দেখলাম, নিচের ফ্রিকোয়েন্সি একদম নষ্ট করে ফেলে টুইটারকে। ওই জোড়া তারের ভেতরের ‘ওপর আর নিচে’র ফ্রিকোয়েন্সিকে আলাদা করে ফেলতে হবে ড্রাইভারে যাবার আগেই। ভালো বুদ্ধি, তাই না?

অ্যামপ্লিফায়ার থেকে আমাদের শব্দ একজোড়া তার হয়ে ঢুকবে স্পিকারে। টুইটার আর উফারে পৌঁছানোর আগেই আলাদা করে ফেলবো এই ‘হাই’ আর ‘লো’ ফ্রিকোয়েন্সিকে। কি দরকার তাহলে? ঠিক বলেছেন। একটা ইলেকট্রনিক সার্কিট বোর্ড। এটাই ক্রসওভার নেটওয়ার্ক। আলাদা করবো কোথায়? ওয়েল, এমন একটা ‘কাট-অফ’ পয়েন্টে যেখানে দুটো ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জকে ‘রিপ্রোডিউস’ করা যাবে দক্ষতার সাথে। শুনতে লাগবে আসলের কাছাকাছি। এটার একটা দুই নাম্বারি আছে অনেকের কাছে। তবে সেটা ঠিক নয় বেশিরভাগ সময়ে। উচ্চমার্গের যতটুকু ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ নিতে পারবে টুইটার, সেখানেই ভাগ করতে পারি ক্রসওভার ফ্রিকোয়েন্সি। অথবা, যেই ‘লো’ ফ্রিকোয়েন্সিটাতে কাটবে না টুইটার, সেটাই আমাদের ক্রসওভার ফ্রিকোয়েন্সি।

আসলেই কি তাই?

প্রতিটা ড্রাইভারের তৈরি শব্দের নিজস্ব রেসপন্স (ওই পরিবেশের সাথে) আর কাভারেজ প্যাটার্ন একটা আরেকটার সাথে কতো সুন্দরভাবে ব্লেন্ড-ইন করতে পারে সেটাই দেখার বিষয় এই ক্রসওভার ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করতে। টুইটার কাটবে কি কাটবে না সেটাও থাকবে আমাদের বিবেচনায়। তবে, মুখ্য হিসেবে নয়। পারফিউমের স্প্রে দেখেছেন সবাই। চাপ দিলে স্প্রে যেভাবে বাস্প হিসেবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেটাকে চিন্তা করি আগে। ওই স্প্রে’র মতো শব্দও ‘স্প্রে’ আকারে ছড়িয়ে পড়ে ড্রাইভার থেকে। শুরুতে ওই ড্রাইভারের গোলাকার অ্যাঙ্গেল ধরে। যতো সামনে যাবে ততোই ছড়িয়ে পড়বে আশেপাশে। টর্চ লাইটের মতো। একটা ডাইরেকশনে। পয়েন্ট সোর্স হিসেবে ওই ড্রাইভার শব্দ ছড়ায় একটা ‘কোন’য়ের মতো। ‘কোন’ আইসক্রিমের ‘কোন’ বললে পরিস্কার হয় বেশি। শব্দ যতো দুরে যাবে ড্রাইভার থেকে, ততো ছড়াবে বেশি। এই ছড়ানোর জায়গাটা হচ্ছে আমাদের শোনার জায়গা। অ্যাকুস্টিকের ভাষায় ‘লিসেনিং এরিয়া’। কাভারেজ প্যাটার্নটা হছে ওই লিসেনিং এরিয়ার একটা ‘আকৃতি’ যেখানে আপেক্ষিক হলেও বাতাসের ওপর সরাসরি সাউন্ড প্রেসার লেভেল প্রায় সমান।

আমার দেখা অনেক বড় বড় সাউন্ড সিস্টেমে ‘ক্রসওভার নেটওয়ার্ক’কে এতোটাই ‘ডাউনপ্লে’ করা হয়েছে সেটা দেখে অবাক হন অ্যাকুস্টিকসের মানুষেরা। আমাদের কথা বাদ, যারা এটা বেঁচে জীবন ধারণ করেন অবাক হন তারাই। এটা জানা যায় বড় বড় ফোরামে গেলে। এটা ঠিক যে আমরা আস্তে আস্তে ভুলতে বসেছি আসল সাউন্ডের ‘সিগনেচার’। এতো ভেজাল শব্দ আমাদের আশেপাশে, কেই বা খেয়াল করবে আসল শব্দের মজা। নয়েজ লেভেল বেড়েছেও অনেক বেশি। অস্বাভাবিক ভাবে।

সত্যি বলতে, আমি গান শোনা কমিয়ে দিয়েছি দিনে। এই শহরে। বরং, ছুটির দিনের মাঝরাতগুলো অনেক অনেক ভালো। ঢাকার বাইরে পোস্টিংগুলো গান শোনার স্বর্গতুল্য। একটা সাধারণ দিনে নয়েজ লেভেল থাকে প্রায় ৪০ ডিবি। সেটাও কিন্তু অনেক বেশি। হয়তোবা আমাদের কানে লাগে না এই নয়েজের আধিক্য। চামড়ার ট্যানারির গল্পের মতো। পঞ্চাশ ওয়াটের একটা সাউন্ড সিস্টেমের ২০% ওপরে আমি যাই না কখনো। অল্প ভলিউমে গান শুনতে হয় ডিটেলস পাবার জন্য। হেডফোনে তো আরো।

তবে এটা ঠিক সত্যিকারের একটা স্পিকার ডিজাইনে খরচ বাড়ে ক্রসওভারের মতো অদৃশ্য জিনিসে। যেটা দেখা যায় না অথবা যেটার মূল্য ক্রেতা দেবেন না সেটার পেছনে খরচ করাও বোকামি। তার মধ্যে জিনিষটা থাকে একেবারে ভেতরে। ক্রেতা বা সেটা দেখবেনই কোথায়? এটা নিয়ে কথা হয়ওনা সেরকম। কয়জন ক্রেতাকে ওই স্পিকার খুলে দেখাবেন আমাদের বিক্রেতারা? খুললেই তো গায়েব ওয়ারেন্টি।

ক্রসওভার নেটওয়ার্ক নিয়ে অনেক গল্প থাকলেও আমরা সেদিকে যাবো না এ বইয়ে। আগেই বলেছি, চাইলে এই জিনিস নিয়ে লেখা যায় পুরো একটা বই। তবে, অডিও সিস্টেমে এই ক্রসওভার লাগানোর জায়গা দুটো। অ্যামপ্লিফায়ারের আগে অথবা পরে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঘোড়ার পরে গাড়ি জুড়ে দেবার মতো পরের অংশটা। অ্যামপ্লিফায়ারের পরে লাগাতে সুবিধা অনেক। এক নম্বর হচ্ছে - খরচ কম। লাগে না এতে এক্সটার্নাল পাওয়ার। প্যাসিভ কম্পোনেন্ট দিয়ে বানানো হয় বলে এটা অনেকটাই আমাদের হাতের নাগালের প্রযুক্তির জিনিস। বানিয়ে এটাকে ঢুকিয়ে দেয়া যায় স্পিকারের ভেতর। একেকটা স্পিকারে একটা করে। প্রতিটা ড্রাইভারের ইম্পিডেন্স রেসপন্সকে ধরে তৈরি করা যায় ওটার ‘সেনসিটিভিটি’র অংশটা। অ্যামপ্লিফায়ারের একেকটা চ্যানেল ধরে আগানো যায় বলে এটার ডিমান্ডও বেশি। আসল কথাটা না বললে নয়। বিশেষ করে আমাদের জন্য। হবিস্ট যারা - মানে আমরা, মনের ভুলে ইলেকট্রিক্যাল শক খাই প্রতিনিয়ত; জিনিষটা বানাতে গিয়ে কার্টুনের মতো মাথার চুল পোড়ার সম্ভাবনা কম। বড় কথা, লাগছে না প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড আর ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই। তাহলে, লাগছে কি এখানে?

এই বোর্ডকে চালাতে দরকার হবে না ...

Last updated